১.
ইংরেজী Aggresion, যার আভিধানিক বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় অন্যায় আক্রমণ। আগ্রাসন বা অন্যায় আক্রমণ হচ্ছে কোন ব্যক্তি, গােষ্ঠী কিংবা দেশকে প্রত্যক্ষ আচরণে, কথায় অথবা মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে আঘাত, উৎখাত কিংবা অবমাননার উদ্দেশ্যে কার্য পরিচালনা করা। কিন্তু আক্রমণকারী কখনোই এই আগ্রাসনের দায় নিতে চায় না,বিপরীতে তারা আত্মরক্ষা,নিরাপত্তা,সভ্যতার রক্ষা ইত্যাদির বুলি আওড়াতে থাকে। এই একই পরিস্থিতি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ,তদূপুরি বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী বরাবরই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে খুবই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের এক দশমাংশ পার্বত্য অঞ্চলকে উপনিবেশের মতনই কেবল নয়,সরাসরি আভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবেই শাসন করে চলেছে। রাজনৈতিকভাবে জুম্ম জনগণকে অধীনস্থ করে রাখতে,তাদের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রামকে বরাবরই বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বে মোড়ানো হয়েছে এবং বর্তমান সময়ে এসেও সেই একই পরিস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি।
রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সবসময়ই নিরাপত্তা ও স্বার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গণ থেকেও(২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১১টি বৈষম্যমূলক নির্দেশনা দেখুন) এক দশমাংশ এই অঞ্চলকে শাসকগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে উল্টো জুম্ম জনগণকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী,সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করে চলেছে। সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈচিত্র্যটাকে অস্বীকার করে,এতদঞ্চলের জন্য বিশেষ আইন থাকা স্বত্ত্বেও,আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন কিংবা প্রতিপালন না করে,এক দমনমূলক নীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। রাষ্ট্র যতই মুখরোচক উচ্চবাক্য কিংবা উন্নয়নের বুলি কপচাক,তার পিছনে এক দূর্ভিসন্ধি থাকে,থাকে রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক ও সমাজিকভাবে আগ্রাসনের নীতি। যতদিন না শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশকে একটি বহুজাতির বহুসংস্কৃতির দেশ হিসেবে স্বীকার করবে,ততদিন তারা এই আগ্রাসী নীতি থেকে কিছুতেই বের হতে পারবে না।
২.
আমরা যখন সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কথা বলি,তখন রাজনীতি,অর্থনীতি অর্থাৎ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একে দেখার কোন সুযোগ নেই। সবকিছুই একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং একে অপরকে প্রভাবিতও করে। এটাই বস্তুর মৌলিক নীতি। এর থেকে ভিন্ন কিছু হতে পারে না। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজাতীয় আগ্রাসনের নীতির সাথে সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক বিষয়টি অত্যান্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেছেন, 'আমরা যা তাই আমাদের সংস্কৃতি। অর্থাৎ কোনো অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের আচার-ব্যবহার, সামাজিক সম্পর্ক,জীবিকার উপায়, সংগীত, নৃত্য,ধর্মীয় রীতিনীতি, শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, নাট্যশালা এ সবই তার সংস্কৃতি। কোনো জাতির পরিচয় তুলে ধরার জন্য সংস্কৃতি এক বিরাট ভূমিকা পালন করে। সংস্কৃতি এমন এক শক্তিশালী উপাদান, যা কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের উন্নতির প্রণোদনা হিসেবেও কাজ করে। একটি দেশের একক সংস্কৃতি যখন অন্যান্য দেশ বা দেশের অভ্যন্তরে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে চায় অথবা বাধ্য করে কোন রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ট সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়া হয়,তখন তাকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশে বাঙালি জাতির বাইরেও ৪৫টির অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। যারা দেশের মূল স্রোতধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে ভাষাগতভাবে,সংস্কৃতিগতভাবে এমনকি অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ পৃথক। যারা ঐতিহাসিকভাবে নিজেদের প্রথাগত ঐতিহ্যকে লালন-পালন করে আসছে এবং বর্তমান সময়ে প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতায় পৌঁছে যাচ্ছে। তারমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে ১৪টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বসবাস,যারা ঐতিহাসিকভাবে স্বতন্ত্রতার সাথে নিজেদের প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত জীবন চর্চা করে আসছে।
সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের যবে থেকে যাত্রা শুরু সেই থেকে এই অঞ্চলকে নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। গল্প ও নাটকীয়ভাবে এতদঞ্চল সম্পর্কে অনেক অসত্য,অদ্ভূত ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থান করে,এই অঞ্চলের মানুষগুলো সম্পর্কে এক ধরনের হীনভাব প্রকাশ করতে দেখা যায়।
আদিবাসীদের চিরতরে ধ্বংস করে দিতে,পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করার বাসনা নিয়ে এবং বাঙলীকরণের এক হীন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রাষ্ট্র তাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার হীন পায়তারা শুরু করেছে। উন্নয়নের ধূঁয়ো তুলে,উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে ধীরে ধীরে তাদের স্বাভাবিক জীবন-জীবিকায় দেয়াল তুলে দিয়েছে রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী।
৩.
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার,সেই সাথে একটি জাতি গঠনে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম দায়িত্বও পালন করে বটে। তাই শিক্ষাকে হতে হয় গণমূখী,ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক।শিক্ষার মাধ্যমেই আবার জাতীয় চেতনারও উন্মেষ ঘটে। নিজেদের ইতিহাস,ঐতিহ্য সংরক্ষণেও তাই শিক্ষার রয়েছে গুরুত্বপূর্ন অবদান। শিক্ষার মাধ্যমেই দেশের ইতিহাস,ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা ধারণা লাভ করে,দেশের সামাজিক,সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে। পৃথিবী যে এত বৈচিত্র্যমন্ডিত ও বহুসংস্কৃতির এক আধার,সেটি শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ প্রাথমিকভাবে জানতে পারে। বিপরীতে এই শিক্ষা যদি গণমূখী ও সার্বজনীন হতে না পারে,তবে সেটি জনগণের একটি অংশকে বৈষম্যের শিকারে পরিণত করতে বাধ্য।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি বিষয়টি আলোচনা করা হয়,তাহলে দেখা যাবে যে চিত্রটি ঠিক কতটা ভংয়কর। পাঠ্যপুস্তকে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অপরাপর আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আদিবাসীদের সম্পর্কে দেশের মূল স্রোতধারার সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে এক ধরনের হীন মানসিকতার জন্ম দেয়া হচ্ছে। তাদের ভাষা,সংস্কৃতি,খাদ্যভাস ও আচার-প্রথাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। অন্যদিকে দেশের মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে রাষ্ট্রযন্ত্র যে কতটা বন্দী,সেটি ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির বেহাল দশা দেখলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধর্মনিরপেক্ষ একটি শিক্ষানীতিকে একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দাবির প্রেক্ষিতে সরকার সেটি পরিবর্তন করে। ২০১৩ সালে এসে সেই ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতিটিকে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না। পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হলো হিন্দু লেখকদের গল্প,কবিতা ও প্রবন্ধগুলোকে,শিশুদের বইগুলোতে "অ-তে অজগর এর বদলে,অ-তে অজু"," আ-তে আম এর বদলে,আ-তে আযান" ইত্যাদি পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়াও যেসব গল্প,কবিতা ও প্রবন্ধ সমূহকে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে,সেগুলোর ছবিগুলোতে পাঞ্জাবী ও টুপি পড়ানো হয়েছে(৩য় শ্রেণীর "চল্ চল্ চল্-কাজী নজরুল ইসলাম")।
অর্থাৎ গল্প,উপন্যাস,কবিতা সর্বক্ষেত্রে ইসলামী ভাবধারা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এককথায় ইসলামী সংস্কৃতিকে পাঠ্যপুস্তকে আনয়ন করা হয়েছে,যা কোমলমতি সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে আরামসে গেলানো হচ্ছে এবং একধরনের ইসলামি চিন্তাধারা তাদের চিন্তায়-মননে প্রবেশ করিয়ে,তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে অথবা নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশে বাধা দেয়া হচ্ছে।
অপরদিকে আদিবাসীদেরও অপরাপর বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায় প্রাথমিক থেকে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা জীবন শুরু করতে হয় এবং সর্বক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন হওয়ায়,আদিবাসী ভাষাগুলোর সাথে বাংলা ভাষার অনেক শব্দ মিশে গেছে। ফলশ্রুতিতে আদিবাসীদের ভাষাগুলো এক সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আদিবাসীদের নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য সরকার এখনো পর্যন্ত কেবলমাত্র ৫টি আদিবাসী ভাষায় পুস্তক বিলি করতে পেরেছে। এছাড়াও উক্ত ৫টি আদিবাসী ভাষায় পাঠদানের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষকের ব্যবস্থা ও তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাষ্ট্র এখনো করতে পারে নি। মোটকথায় আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন প্রকার আশানুরুপ ফল এখনো আমরা দেখতে পায় না।
৪.
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি অতি সস্তা বাক্য হচ্ছে উন্নয়ন। তারা মুখে মুখে এতই উন্নয়নের জোয়ার তুলে যে,সেই জোয়ারে কখনও কখনও কোন জাতিগোষ্ঠী একেবারে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় উন্নয়নের সাথে আগ্রাসন শব্দটি ওতপ্রোতভাবেই জড়িত। কারণ আপনাকে উন্নয়ন করতে গেলে কাউকে না কাউকে আগ্রাসন করতেই হবে। যেহেতু পুঁজিবাদী সমাজে জনমানুষের কল্যাণের চাইতে লাভের উদ্দেশ্যকেই বেশি প্রধান্য দেওয়া হয়,সেহেতু এই উন্নয়ন কেবল রাষ্ট্রের একটি ক্ষুদ্র অংশের জন্য ভালো হয়,বাকি সংখ্যাগরিষ্ট জনমানুষের কাছে এটি একটি আগ্রাসনই বটে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায়ও আমার রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হরহামেশাই উন্নয়নের কথা শুনি। কিন্তু এই উন্নয়ন বাস্তবে কার স্বার্থে? রাষ্ট্র ঘোষিত সেই উন্নয়ন কি জুম্ম জনগণের সামাজিক,সাংস্কৃতিক কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থার কোন উন্নয়ন ঘটাতে পারছে? এককথায় উত্তর আসবে,না।
তাহলে এই উন্নয়নকে আদৌ পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য উন্নয়ন বলা যায় কি করে!
বস্তুতপক্ষে,এই উন্নয়নের নাম দিয়েই পাহাড়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে আরো জোরদার করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আমরা দেখেছি,উন্নয়নের নাম দিয়ে পাহাড়ে ঝিরি-ঝর্ণা থেকে পাথর উত্তোলন,বনভূমি ধ্বংস করে,পাহাড়ের প্রাণ প্রকৃতির উপর আঘাত করে বিশাল বড় বড় ট্রানজিট নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। যেগুলোর দ্বারা পাহাড়ীরা নিজেদের বাস্তুভিটা থেকে প্রতিনিয়তই উচ্ছেদ হচ্ছে। সেই সাথে রয়েছে জায়গার নামসমূহের বিকৃতকরণ। পাহাড়ীদের ঐতিহ্যগত নামগুলো পাল্টিয়ে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে অথবা কোনটিকে সরাসরি বাতিল করে দিয়ে বাঙালীয়ানা কোন নাম দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে ঝিরি-ঝর্ণা থেকে পাথর উত্তোলন ধ্বংসের ফলে পাহাড়ীরা যে পানি সংগ্রহের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে এইসব ঝিরি-ঝর্ণার উপর নির্ভরশীল,সেটি ব্যহত হচ্ছে। ঝিরি-ঝর্ণাতে পাওয়া বিভিন্ন প্রকারের মাছ,চিংড়ি,ব্যাঙ,ব্যাঙাচি পাহাড়ীদের প্রিয় খাদ্য তালিকায় থাকে। পাথর উত্তোলন করার ফলে পর্যাপ্ত জল না থাকায় পাহাড়ীদের এসব খাদ্যবস্তুর ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবন চর্চায় ব্যঘাত ঘটছে। বনভূমি ধ্বংস করার ফলে পাহাড়ীদের সংস্কৃতি চর্চায় বিরুপ প্রভাব পড়ছে। পাহাড়ীদের বেশিরভাগ বাড়িই নির্মিত হয় বাঁশ,গাছ,বাঁশের পাতা,শন ইত্যাদি দিয়ে। পাহাড়ীরা এগুলো বন থেকেই সংগ্রহ করে। বাড়ি তৈরিতে রশি হিসেবে ব্যবহৃত একধরনের বস্তু(চাকমা ভাষায় বেত),সেটি বাঁশ দিয়ে তৈরি। অপরপক্ষে নিজেদের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র,খাল্ল্যোং,টুরুং,তোলোই,প্রায় সমস্ত কিছুই বাঁশ এবং বেত দিয়ে তৈরি। যেগুলো তৈরি করতে বনের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক।
তাছাড়া,পাহাড়ী নারীরা তাদের পড়নের পিনোন,খাদি নিজেরাই তৈরি করে। এগুলো তৈরি করতে প্রয়োজনীয় উপকরণ তূলা,নাদেই,চুচ্চেক বাঁশ,ব-হাদি,তাগলক,বিয়োং ইত্যাদি সমস্ত কিছুই জুম এবং বন থেকে সংগ্রহ করা গাছ ও বাঁশের সাহায্যে তৈরি করা হয়। উন্নয়নের নামে যখন রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং কোম্পানী কর্তৃক হাজার হাজার একর বনভূমি দখল ও ধ্বংস করা হয়,তখন আদিবাসীদের সংস্কৃতিও হুমকির সম্মুখীন হয়। অর্থাৎ শাসকগোষ্ঠীর উন্নয়নের সাথে আদিবাসীদের উপর আধিপত্য করার মানসিকতা প্রতি পদে পদে পরিলক্ষিত হয়।
৫.
১৯৭৩ সালে সর্বপ্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩টি স্থায়ী সেনানিবাস স্থাপন করা হয়। সেই থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও পাঁচ শতাধিক সেনাক্যাম্প রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর(বর্তমান বিজিবি)। সীমন্ত এলাকায় যত্রতত্র চলছে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনের মহাযজ্ঞ। আর এইসব সেনা-বিজিবি ক্যাম্পগুলো বরাবরই পাহাড়ীদের রথাগত ও ঐতিহ্যগত মৌজাভূমি বা জুমভূমি,শ্মশানখোলা,ব্যক্তিগত ভোগদখলীয় ভূমিকে দখল করে স্থাপন করা হয়েছে। অর্থাউ পাহাড়ীদের প্রথাগত ভূমি অধিকারকে ভূলন্ঠিত করে দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে এই ক্যাম্পগুলো যে জায়গায় স্থাপন করা হয়,সেই জায়গার পাহাড়ী নামকে বিকৃত করে ভিন্ন নাম দিয়ে বড় বড় সাইনবোর্ড জুলিয়ে দেয়া হয়। পাহাড়ের বিভিন্ন ঝিরি,পাহাড়,ভিটার নামকরনের পিছনে পাহাড়ীদের একেকটা ইতিহাস আছে,সেই সাথে রয়েছে পাহাড়ীদের নিজস্ব সংস্কৃতির সম্মিলনও। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীরা বরাবরই নিজেদের ইচ্ছামতন সহজবোধ্য নাম দিয়ে,পাহাড়ীদের ঐতিহাসিক নামগুলোকে বিকৃত করে দিচ্ছে। যেমন-বিলাইছড়ির গাছহাবা ছড়ার সেনাক্যাম্পের নাম দেওয়া হয়েছে "গাছকাটা ছড়া সেনাক্যাম্প"। বরকল উপজেলার " তাগলকবাগ" এলাকার নাম বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে "তবলাবাগ"। বরকলের " ফালিটাঙ্যে চুগ" এর নাম বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে "পাকিস্তান টিলা"। লংগদুর " মাল্যে" এর নাম বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে "মাহিল্যা" ইত্যাদি।
অপরদিকে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করে একই সাথে যেমনি পাহাড়ের প্রথাগত ভূমি অধিকারকে হরণ করা হচ্ছে এবং ভূমি দখলের ফলে পাহাড়ীদের ঐতিহ্যবাহী জুমচাষের জন্য ভূমি সংকট সৃষ্টি হচ্ছে,ঠিক তেমনি পর্যটন কেন্দ্রগুলোর নামকরণ করা হচ্ছে পাহাড়ীদের ঐতিহ্যগত নামগুলোকে বিকৃত করে,কোনটি বা একেবারে নতুন নাম দিয়েই। বিশেষ করে বান্দরবানের দিকে দৃষ্টি দিলে এটি আরো বেশি স্পষ্ট হবে। যেমন-বান্দরবানের কাপ্রু ম্রো পাড়াকে নীলগিরি,নাইটং পাহাড়কে চন্দ্রপাহাড়,হাতিভাঙা তাং ও এম্মেন তাং থেকে নীলাচল,ক্রাউডং থেকে ডিমপাহাড়,ইয়াংবংহুং থেকে চিম্বুক,লুংমাইচাম থেকে টেবিল পাহাড়,সীতাপাহাড় থেকে পিক৬৯,চাইখ্যাংভা থেকে শৈলপ্রপাত,ডলুঝিরি মাথা থেকে মেঘলা।
এধরনের ভূড়ি ভূড়ি উদাহরণ রয়েছে,যেখানে ইচ্ছাকৃতভাবেই পাহাড়ীদের এতিহ্যগত নামগুলোকে বিকৃত করে,নিজেদের ইচ্ছামাফিক বাঙালী নাম দেওয়া হয়েছে। আর এভাবেই সময়ের আবর্তে পাহাড়ীদের সেই নামগুলো হারিয়ে যাওয়ার রহর গুনতে থাকে এবং একটা সময় হারিয়েও যায়।
৬.
পাহাড়ে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ এতদঞ্চলের সংস্কৃতির উপর এক কালো ছায়া ফেলে। এত বিশাল সংখ্যাক রাষ্ট্রীয় অভিবাসনের ফলে পাহাড়ীদের স্বাভাবিক জীবন প্রণালী,আচার-ব্যবহার,রীতি-নীতি সমস্ত কিছুতে এক বিরুপ প্রভাব পড়েছে,এটি সত্য। বিশাল এই বাঙালী জনগোষ্ঠী এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জনগোষ্ঠীর সাথে সমানে সমান বা তারও অধিক। ফলশ্রুতিতে তাদের প্রচলিত জীবন-প্রণালী,রীতি-নীতি,সংস্কৃতি চর্চা পাহাড়ীদের জীবন-প্রণালী ও সংস্কৃতি চর্চার উপর আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে।
অপরদিকে এই বহিরাগতদের মননে একধরনের জুম্ম বিদ্বেষী ভাব রয়েছে,যেটি তাদের কাজকর্মের দ্বারা,তাদের দ্বারা সংগঠিত ডজনের অধিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দ্বারা অতি পরিষ্কারভাবে বুজতে পারা যায়। তাদের আগমনের পর থেকেই পাহাড়ীদের মনে একধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। ফলে পরোক্ষভাবে নিজেদের প্রথাচর্চা ও সংস্কৃতি চর্চাতেও এই বহিরাগতরা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর অন্যতম কারণ,জুম্ম জনগণের অনিরাপত্তা(বিশেষভাবে জুম্ম নারী)। আর এই অনিরাপত্তার পিছনের কারণটা সেনা এবং বহিরাগত সেটেলার।
স্বাভাবিকভাবেই আমরা দেখতে পাচ্ছি,জুম্ম জনগণের সংস্কৃতি আজ কতটা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পু্ঁজিবাদী যুগের উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুম্ম জনগণের সনাতনী উৎপাদন ব্যবস্থা লড়াইয়ে টিকে থাকবে না,এটিও সত্য। বর্তমান সময়েও প্রায়শই দেখা যাচ্ছে,জুমনির্ভর যে বহুফসলী উৎপাদন প্রক্রিয়া,সেটি করতে এখন পর্যাপ্ত ভূমি আমরা পাচ্ছি না। এছাড়াও আমাদের নিজস্ব পোশাকী রীতির চল রাখতে যে পরিমাণ উপকরণ দরকার,আমরা সেটিও পর্যাপ্ত পাচ্ছি না,ফলশ্রুতিতে আমাদের নিজস্ব রীতিতে তৈরি পোশাক-পরিচ্ছদগুলোর দাম আকাশ ছোঁয়া। আর অন্যদিকে পুঁজিবাদের ছোঁয়ায় সস্তায় পণ্য উৎপাদন হচ্ছে এবং সেগুলো পরতেও অনেক স্বাচ্ছন্দ্যমন্ডিত। ফলশ্রুতিতে আমরা সেটিই ব্যবহার করছি,যা সহজলভ্য,আরামদায়ক,দামে কম এবং সুন্দরও বটে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের সংস্কৃতিকে বিজাতীয় একটি সংস্কৃতি গ্রাস করে চলেছে। আমাদের উপর কখনও জোরপূর্বক আধিপত্য বিস্তার করে,কখনও বা সুকৌশলে আধিপত্য বিস্তার করে।
মোটকথায়, আমাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কৃতি যখন আজ ধ্বংসের মুখে,তখন সামগ্রিকভাবে জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক অধিকার ব্যাতীত এটিকে সংরক্ষণ করার কোন উপায় নেই। উপরেই বলেছিলাম,সমস্ত কিছুই একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং একে অপরকে প্রভাবিতও করে। তাই জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের মধ্যেই রয়েছে আমাদের সংস্কৃতি,অর্থনীতি রক্ষার মূলমন্ত্র। যার মাধ্যমে বিজাতীয় শাসকের দ্বারা নয়,আমরা স্বয়ং নিজেরাই নিজেদের পরিচালিত করবো,আমাদের দ্বারা, আমাদের জন্য।
লিখেছেনঃ মিতুল চাকমা বিশাল,পাহাড়ের আদিবাসী অধিকার কর্মী
No comments:
Post a Comment