সঞ্চারণ চাকমা
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক দশমাংশ অঞ্চল এবং বাংলাদেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও এতদঞ্চল সম্পর্কে আমাদের আজকের তরুণ প্রজন্মের ধারণাটা একেবারে নগণ্য এবং অসম্পূর্ণও বটে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠীর (বাঙালি) আজকের প্রজন্মের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে অনেক উদ্ভট ধারণা রয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং বিশেষভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে সে ধারণাটা আরো অপ্রতুল বলেই মনে হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পরিচালন পদ্ধতিকেই আমি দোষারোপ করছি, কেননা দেশের যেকোনো প্রান্তের খবরাখবর জনমানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটি মিডিয়া কিংবা সংবাদ মাধ্যমগুলো করে থাকে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত দেশের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসমূহে পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যাগুলিকে পরিচিহ্নিত না করে, সেগুলোকে তুলে না ধরে বরং এতদঞ্চল সম্পর্কে শাসকশ্রেণির চাপিয়ে দেওয়া এবং তথ্যবিহীন ভুল সংবাদ পরিবেশন করা হয়। কোন কোন সংবাদ মাধ্যম চাপের মুখে এসব কথা প্রকাশ করলেও বেশিরভাগ মাধ্যম কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে কোনরূপ বিচার-বিশ্লেষণ না করেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে একধরনের খারাপ বার্তা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। যার ফলশ্রæতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যাটি যে রাজনৈতিক, সেটি তখন চাপা পড়ে যায় সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রতা আর সন্ত্রাসবাদের গভীরে। সেইসাথে এটিও অনস্বীকার্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে কোন সংবাদ প্রকাশ করতে একটি বিশেষ গোষ্ঠী সেন্সর করে থাকে। সুতরাং, সেখানে ভালো, তথ্যবহুল, যৌক্তিক ও গঠনমূলক সংবাদ পাওয়া অবশ্যই দূরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে যারা স্বয়ং এসে এই অঞ্চলের বাস্তব পরিস্থতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে চান, তাদের অনেকেরই থাকে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ, বিষয়গুলোকে কেবল একটি দিক দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা। সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলোকে অনুধাবন করতে না পারা, একটির সাথে আরেকটির সম্পর্ককে জানতে না পারা ইত্যাদি সীমাবদ্ধতাও এই প্রজন্মের অনেকের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ভুল ধারণার জন্ম দেয়।
কিছুদিন আগে গত ২৯ নভেম্বর কুষ্টিয়া ইসলামি ইউনিভার্সিটির মাস্টার্সে অধ্যায়নরত জুয়েল রানা নামে এক ছাত্রের পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তির লেখা পড়ে রীতিমত হতাশ না হয়ে পারি নি। কেননা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যায়ন করেও দেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ সম্পর্কে তার এধরনের বিচার-বিশ্লেষণ তার ছাত্রত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস আর মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। সুতরাং সেই প্রতিষ্ঠানের একজন ছাত্রের সংকীর্ণতা আর সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব পোষণ করা এবং কোন কিছু সম্পর্কে সঠিকভাবে, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে কিছু না জেনেই সেটি সম্পর্কে বিষোদগার করা, এসমস্ত বিষয়গুলো কোনমতেই কাম্য হতে পারে না। তার লেখার প্রতিটি পয়েন্টে তার জানার সীমাবদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু আমি সেগুলো বিস্তারিত না বলে, পয়েন্ট আকারে কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
ক. পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর বৈধতা/অবৈধতা:
বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর সর্বমোট সদস্য সংখ্যা ১,৪৮,৬১৭ জনের মতো। তার মধ্যে তিনভাগের এক ভাগ পার্বত্য চট্টগ্রামে মোতায়েন রয়েছে। সেনাবাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং যুদ্ধোন্মুখ পরিস্থিতি বা জরুরী অবস্থার মুহূর্তেই তাদের মোতায়েন করা হয়ে থাকে। কিন্তু এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের এক দশমাংশ এলাকা হলেও এই পুরো অঞ্চলটিকে এখন সেনাবাহিনীর জলপাই রঙে ভরাট করে দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে মানতে না চাওয়ার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং এর প্রভাব সমগ্র বাংলাদেশে পড়তে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেহেতু পাহাড়ি আদিবাসী সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, সুতরাং এতদঞ্চলের রাজনৈতিক ক্ষমতা বা রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দাবি করাটা অযৌক্তিক নয়। তাছাড়াও দেশের মূল স্রোতধারার বাঙালি জনগোষ্ঠীর চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চল বিশেষ শাসনব্যবস্থার দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বিশেষ অঞ্চল এবং এই অঞ্চলের জন্য অবশ্যই বিশেষ শাসনব্যবস্থার প্রয়োজন আছে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলাকে স্বতন্ত্র করে বাংলাদেশ নামে পরিচিত করার মধ্যে যে যৌক্তিকতা রয়েছে, ঠিক তদ্রুপ বাংলাদেশের ভেতরে থেকে ভাষাগত, সংস্কৃতিগত আলাদা সত্তাবিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও একই কথা আরো বেশি করে প্রযোজ্য।
চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৫০০ এর অধিক সেনাক্যাম্প ছিল। চুক্তির পরে সরকারের দাবি তারা ২৪০টি ক্যাম্প সরিয়ে নিয়ছে। কিন্তু আঞ্চলিক পরিষদে কেবলমাত্র ৭৮টি ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়ার চিঠি পাঠানো হয়েছে এবং ২০০৯ সাল থেকে সেই প্রক্রিয়াটি এখন বন্ধ রাখ হয়েছে। বরং উল্টো এখন পুনরায় ক্যাম্প সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
এখন আসি মূল কথায়, সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিয়োজিত। সুতরাং তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকার বৈধতা আছে। তবে তার মানে এই নয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে যত্রতত্র ক্যাম্প বসিয়ে রাখতে হবে। সেনাবাহিনীর বৈধতার অর্থ এই নয় যে, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন বজায় থাকতে হবে। সেনাবাহিনী থাকবে, তবে দেশের বাকি ৬১টি জেলার ন্যায়, সেনানিবাসে থাকবে। প্রয়োজন হলে সাধারণ প্রশাসন তাদের মাঠে নামাবে। সংকটময় মুহূর্ত দেখা দিলে তারা মাঠে নামবে সংকট মোকাবেলায়, কিন্তু সেটি কেবল সংকটকালীন মুহূর্তে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ কি পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা বা মায়ানমারের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত অথবা যুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে? যদি তাই না হয়, তবে দেশের এক-তৃতীয়াংশ সেনাবাহিনীকে এই অঞ্চলে বৈধতা দেয়ার কী অর্থ দাঁড়ায়? তাহলে বাংলাদেশের অপরাপর সীমান্তবর্তী জেলা সিলেট, কুমিল্লা, ফেনী, পঞ্চগড়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রভৃতি জেলাগুলিতে কেন সেনা মোতায়েন করা হবে না? বাংলাদেশের বাকি ৬১টি জেলায় হর-হামেশাই জঙ্গীবাদ আর সন্ত্রাসবাদের খবর পাওয়া যায়। তবে সেখানে কেন সেনাক্যাম্প বসানো হয় না? রাষ্ট্রের জন্য কি সেগুলো হুমকি নয় তাহলে?
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সুতরাং এতদঞ্চলের জন-মানুষের রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। তবে কেন বর্তমান সময়ে এখানে এত সেনাক্যাম্পের ছড়াছড়ি? কিসের উদ্দেশ্যে তারা এখানে মোতায়েন রয়েছে? এই প্রশ্নগুলো অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে।
খ. বহিরাগত বাঙালি/সেটেলার:
‘সেটলার’ আমরা কাদেরকে বলছি? অনেকেই এই শব্দটি নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করেন। কিন্তু সেগুলো কেবল হুজুগে আপত্তি। প্রথমত, খুব বেশি দুরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার হিসেবের দিকে চোখ বুলালে দেখা যাবে যে, এই অঞ্চলে পাহাড়িরা তখন ৯৭% এর অধিক ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই হিসাব এখন ৫১% হয়ে গিয়েছে। তার মানে বাকি ৪৯% বহিরাগত, অর্থাৎ সেটলার। তারা কেউ স্ব-ইচ্ছায় আসেনি, রাষ্ট্র নিজেই তাদের রেশন দিয়ে অনুপ্রবেশ করিয়েছে। জুম্ম ধ্বংসের হীন কার্যকলাপের অংশ হিসেবে, এই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
স্বাধীনতার পরপরই রাষ্ট্র প্রথমদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের রাজনৈতিক দাবিকে উপেক্ষা করেছিল। কেননা রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণীর মধ্যে একধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদিতা এবং দাম্ভিকতার ছাপ ছিল। ফলশ্রুতিতে তারা সংখ্যাল্প ভিন্ন সংস্কৃতির অধিকারী এই মানুষগুলোর যৌক্তিক দাবিকে নাকচ করে দিয়ে, তাদেরকে বাঙালীকরণের এক হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় (খোদ বাংলাদেশের সংবিধানে ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে)। ফলশ্রুতিতে একদিকে যেমন নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঢেকে ফেলা হয়, অপরদিকে বহিরাগতদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ করিয়ে এতদঞ্চলের জনমিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করা হয়। আর পরবর্তীতে এই বহিরাগতদেরকেই রাষ্ট্র পাহাড়িদের বিরুদ্ধে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং করছে। প্রকৃতপক্ষে সেই সমস্ত নদী-ভাঙা, চড়-ভাঙা অসহায় মানুষগুলোর প্রতি রাষ্ট্রের কোন মানবতা বা দরদ নেই। বরং তাদের অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে উগ্রতার বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র। মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে উন্নত জীবনের আশ্বাস দিয়ে তাদেরকে এখানে বসতি প্রদান করিয়েছে এবং পাহাড়িদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। পরবর্তীতে দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় এখন আর লেলিয়ে দেওয়া প্রয়োজন হয় না, তারা স্ব-প্রণোদিত হয়েই এখন সেগুলো করে। কেননা এত দীর্ঘ সময়ে একই কাজ করতে করতে, সেটি তাদের মজ্জাগত আর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে প্রথমদিকে তাদের চোখে অসহায়ত্বের ছাঁপ থাকলেও এখন সেটি নেই, এখন রয়েছে উগ্র-সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প।
গ. কথিত পাহাড়ি সন্ত্রাসী:
কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতেও সন্ত্রাসী রয়েছে। কক্সবাজার, বাগেরহাটে ডাকাত দল রয়েছে, স্বর্ণ ও ইয়াবা পাচারকারী রয়েছে, দেশ থেকে মোটা অংকের টাকা বিদেশে পাচারকারী রয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযান পরিচালনা করতে রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে মাঠে নামতে হয় না। অন্যদিকে একদল লোক দাবি করে, পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সেখানে সন্ত্রাসী দমন করতেই সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব থাকতে হবে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
বস্তুতপক্ষে পাহাড়ে যেসমস্ত অস্ত্রধারী গ্রুপগুলো দেখা যায়, সেগুলো কাদের সৃষ্টি? কিসের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে? এই বিষয়গুলোকে কেউ সামনে নিয়ে আসতে চায় না। কেবল পাহাড়ি সন্ত্রাসী বলেই উড়িয়ে দিতে চায়।
তাহলে বাংলাদেশে যত ডাকাত, পাচারকারী, জঙ্গীগোষ্ঠী রয়েছে সবাই তো বাঙালি এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশী। সেগুলো অবশ্যই বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে তাহলে! বাঙালি জাতির লোক যেহেতু সেইসব গোষ্ঠীকে বাঙালি ডাকাত, বাঙালি পাচারকারী, বাঙালি জঙ্গীগোষ্ঠী কেন বলা হয় না?
আমেরিকায় কোন জঙ্গী হামলা হলে, পরমুহূর্তেই ইসলামিক স্টেট অব ইরাক-সিরিয়া তার দায় স্বীকার করে নেয়। তাহলে বাংলাদেশের আপামর মুসলিম জনতা কেন তার দায় নেয় না?
তৎক্ষণাৎ কেন কেউ এসে বলে দেয় যে, ‘সন্ত্রাসীরা কারো ভাই হতে পারে না, তাদের কোন ধর্ম নেই, তারা কোন জাতির হতে পারে না।’ কি সাংঘাতিক কথা! তাহলে পাহাড়ের সন্ত্রাসীদের সমস্ত বোঝা কেন পাহাড়িদেরকেই চাপানো হয়? প্রশ্ন থেকেই যায়।
এখন দেখা যাক, কথিত পাহাড়ী সন্ত্রাসীগুলোর অবস্থান ঠিক কোথায়? পার্বত্য চুক্তির সাথে এদের সম্পর্কটাই বা কী রকম!
প্রথমত, বিভিন্ন মিডিয়া, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যাদেরকে পাহাড়ি সন্ত্রাসী বলে চুক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, সেইসমস্ত গ্রুপগুলো আসলে রাষ্ট্রের একটি বিশেষ বাহিনীরই সৃষ্ট। লক্ষ্য করার মতন একটি বিষয় যে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর জনসংহতি সমিতি তাদের অস্ত্র ত্যাগ করার মধ্যদিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত এসেছে এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় তাদের চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পাহাড়ে যেসমস্ত সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো দেখা যায়, সেগুলো সেনাক্যাম্পের অতি নিকটে কী করে থাকে? যদি সেনাবাহিনীর সাথে তাদের সখ্যতা না থাকে, তবে একটি স্বশস্ত্র গোষ্ঠী কিভাবে এত নাকের ডগায় থাকতে পারে, এই প্রশ্নের মীমাংসা করাটাও জরুরি। নানিয়াচর সদরে, জীবতলীতে নেভী ক্যাম্পের অতি নিকটে স্বশস্ত্রভাবে অবস্থান, সুবলং বাজারে সেনাক্যাম্পের নিকটে স্বশস্ত্র অবস্থান, বাঘাইছড়ির বাবুপাড়ায় একদম নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরায় অবস্থান এবং দীঘিনালার বড়াদম এলাকার থানার পার্শ্বে স্বশস্ত্রভাবে অবস্থান, যেটি থেকে সেনাক্যাম্পের দূরত্ব আধা কি.মি. এর চেয়েও কম।
আর এসমস্ত গ্রুপগুলো বরবারই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী সেই অপশক্তিগুলিকেই বুকে আগলিয়ে রেখেছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে সন্ত্রাসবাদের ইস্যুটিকে জিইয়ে রেখেছে। যদি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকত, তাহলে কখনোই চুক্তি বিরোধী কোন অপশক্তিকে তারা আপন করে নিতো না।
অন্যদিকে বিদেশী কিছু স্বশস্ত্র গোষ্ঠী যেমন, আরাকান লিবারেশন পার্টি, রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি, মগ পার্টি প্রভৃতি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে রাষ্ট্র মদদ দিয়ে চলেছে। বেপরোয়া এইসব গ্রুপগুলো নিরাপত্তা বাহিনীর নাকের ডগায় বসে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জুম্ম জনগণকে প্রতিনিয়ত হয়রানি ও উৎপাত করে বেড়াচ্ছে। গত বছরের আগস্ট মাসে রাজস্থলীতে এরকম একটি দল সেনাবাহিনীর টহল দলের উপর ভুলবশত হামলা চালায়। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন ১৯ আগস্ট ২০১৯ বিবিসিকে বলেছিলেন যে,‘আমি ছবিতে তাদের হাতে যে অস্ত্রগুলো দেখেছি, সেগুলো অত্যাধুনিক হাতিয়ার এবং তাদের ইউনিফর্মটা জলপাই রঙের। তাদের গড়ন দেখে বুঝা যায় যে, তারা হিল ট্র্যাক্টস এর মেজর কোন ট্রাইবের সদস্য নয়।’ এদের সঙ্গে সাউদার্ন ট্রাইবগুলোর অনেকটা মিল লক্ষ্য করা যায় বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
তাহলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এত নিরাপত্তা চৌকি থাকা স্বত্তে¡ও কী করে এতগুলো দেশি এবং বিদেশি স্বশস্ত্র গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান করতে পারে, এই প্রশ্নটারও মীমাংসা করা জরুরি।
অন্যদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন অনুসারে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের দ্বারা বছরে ৪'শ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয় বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তারা এইটা দেখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে বছরে ঠিক কত হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয় এবং ঠিক কী পরিমাণ কাঠ ও পাথর পাচার করা হয়। যেগুলোর সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত একটি সংস্থা এবং সরকার দলের উচ্চ পদস্থ নেতা-কর্মীও যুক্ত। কেবলমাত্র রাঙামাটির বনজ সম্পদ থেকে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে বছরে ৪৫১ কোটি ১২ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয় (সুত্র: হিল ভয়েস, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২০)।
সেই সাথে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক যত্রতত্র কাঠ নামিয়ে রাখার কথাও জানা যায়। তাহলে বাকি ২ জেলা, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে গড় হিসেব করলে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১৩'শ কোটি টাকা। এছাড়া বান্দরবান থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন করে বছরে লক্ষ লক্ষ ঘনফুট পাথর পাচার করা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে। এই পাথর চোরাচালানের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সংস্থা জড়িত বলেও স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে (সুত্র:কালের কন্ঠ, ২১ডিসেম্বর,২০১৯)।
ঘ. ইসলামিক জঙ্গীগোষ্ঠীর তৎপরতা:
১৯৬১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে মসজিদের সংখ্যা ছিল ৪০টি, মাদ্রাসা ছিল ২টি। জিয়ার আমলে ১৯৮১ সালে মসজিদের সংখ্যা হয়েছে ৫৯২টি এবং মাদ্রাসা ৩৫টি। ২০১০ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে মসজিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০০ এ এবং সরকারি-বেসরকারি মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮০০ (সুত্র : বিডিনিউজ২৪.কম,১০ জানুয়ারী ২০১০)। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে মসজিদের এ সংখ্যটা ৩৬০০ এর অধিক। খাগড়াছড়িতে ২৪৭২ টি,রাঙামাটিতে ৪৬২ টি এবং বান্দরবানে ৭২২টি মসজিদ রয়েছে। এই আনাচে কানাচে প্রতিস্থাপিত মসজিদ এবং মাদ্রাসাগুলোই পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামীকরণের এক একটা কারখানা এবং সেই সাথে হয়ে উঠেছে একেকটি জঙ্গি আস্তানা।
১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মধ্যদিয়ে হারকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ(হুজি-বি) আত্মপ্রকাশ করে। যাদের অধিকাংশই মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত এবং তারা আফগান যুদ্ধের গেরিলা যুদ্ধ ও ভারী অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণও পেয়েছিল। এই হারকাতুল জিহাদ মূলত মাদ্রাসা থেকেই তাদের সদস্য সংগ্রহ করে। এজন্যে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশের মাদ্রাসা ছাত্রদের জঙ্গী তৎপরতায় উদ্বুদ্ধ করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের (বিশেষ করে বান্দরবানে) দূর্গম এলাকায় অবস্থিত মাদ্রাসাসমুহকে প্রশিক্ষণ আস্তানা হিসেবে ব্যাবহার করে। অন্যদিকে মায়ানমারের সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠন আরসা, আরএসও, এআরএনও ইত্যাদির সাথেও তারা যোগাযোগ রাখে। অনেকটা কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের মাদ্রাসাগুলোকে তারা তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।
২৩ মার্চ ২০১৫, জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ এর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক প্রধান এরশাদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এসময় এরশাদ স্বীকার করেন যে,বাংলাদেশ,ভারত এবং মায়ানমার কেন্দ্র করে একটি ইসলামিক স্টেট গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। এজন্যে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরির জন্য কাজ করছিলেন। (সুত্র:সমকাল, ২৪ মার্চ ২০১৫)
মিয়ানমারসংলগ্ন বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার উখিয়া, টেকনাফ, রামু, নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, কক্সবাজার সদর উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গীরা নানা নামে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে জঙ্গীপনার জাল বুনেছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা আরাকান বিদ্রোহী গ্রæপের আরএসও ক্যাডাররা জঙ্গীপনায় সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের রক্ষার ঢাল হিসেবে চালিয়ে নিতে বিভিন্ন স্থানে এক একটি মাদ্রাসা-এতিমখানা ও ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছে। আর এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তরালে চালানো হয়ে থাকে জঙ্গী কর্মকান্ড। বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসা ও এতিমখানার নামে তারা দখল করে নিয়েছে বন বিভাগের বিপুল পরিমাণ জমি। এসব কাজে সরকারী দল সমর্থিত কতিপয় নেতাকে বশে এনে জঙ্গীরা সহজে সরকারী জমিতে গড়ে তুলেছে অসংখ্য স্থাপনা।(সুত্র: জনকন্ঠ, ২ মার্চ ২০১৫)
পাকিস্তান, সৌদিআরব এবং সর্বোপরি ওআইসির সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে নামে বেনামে মাদ্রাসা এবং মসজিদ নির্মাণ করে একেকটি প্রতিষ্ঠানকে জঙ্গীদের আস্তানায় পরিণত করা হয়েছে। এসব স্থাপনায় স্থানীয় পাহাড়িদের ভোগদখলীয় ভূমি, মৌজাভূমি/জুমভূমি দখল করা হয়েছে এবং সেগুলো অবশ্যই স্থানীয় প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের সহায়তায় তারা করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার ধারাবাহিকতায় এতদঞ্চলে মুসলিম বাঙালি অভিবাসনের কারণে জঙ্গী মৌলবাদের ঘাঁটি স্থাপন ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে।
শেষ কথা:
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় এলাকা। যুগ যুগ ধরে ঐতিহাসিকভাবে পাহাড়কে রক্ষা করে চলা পাহাড়িদের রাজনৈতিক অধিকারকে অস্বীকার করে এই অঞ্চলের মানুষদেরকে বঞ্চিত রেখে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কিংবা অগ্রগতি কোনটাই সম্ভব নয়। সুতরাং এতদঞ্চলের জন-মানুষদের স্বার্থ বিবর্জিত, চুক্তি পরিপন্থী কেন কার্যক্রম রাষ্ট্রের হাতে নেওয়া উচিত নয়। আমরা চাই, আমাদের রাজনৈতিক অধিকার। আমরা বাঙালি কিংবা বাংলাদেশ বিরোধীও নই। সেকারণে চুক্তির প্রস্তাবনায়, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া......." শব্দগুলি স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে। অতএব, বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে সত্যকে জানতে হবে, বাস্তব বিবর্জিত কোন মনগড়া তথ্য উপস্থাপন করা একজন তারুণ্যের কাজ হতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যাকে দেশের এবং দেশের বাইরে প্রচার-প্রসারের দায়িত্বটিও এই তরুণ প্রজন্মকেই নিতে হবে। একটি সুন্দর, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন করতে হলে, সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাদ দিলে চলবে না। কেননা পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাইরের কোন অঞ্চল নয়। সুতরাং, কেবলমাত্র হাওয়ার উপর ভেসে বেড়ানো, কিংবা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রচার করা সংবাদ বা তথ্যের উপর ভিত্তি না করে, সমস্যাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। সমস্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাধানের পথে এগোতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে কেবল অন্ধকারই পড়ে থাকবে।
1 comment:
Good
Post a Comment