শৈলেন চাকমা
"বিদায় শব্দটি বোধহয় কারো কাছে নতুন প্রত্যাশার সুচনা ,আর কারোর কাছে আবেগে জর্জরিত।যদি বলি বিদায় যদি হয় চির অচেনার পথে পাড়ি জমানোর বিদায়,তাহলে দুংখের তাৎপর্য ছাড়া কিছুই না।আরেক বিদায় হলো, নতুন কিছু সৃষ্টির প্রত্যাশার খোঁজে।যে বিদায় যদি হয়, চির দিনের বিদায়।
প্রিয় শহীদ কমরেড 'রনক' তোমার মৃত্যুবার্ষিকীর একটি বছর পূর্ণ হলো আজ।আজ তোমায় গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।শাসকগোষ্ঠীর নব্য সংস্করণ লেজুর বাহিনীর প্রবঞ্চকরা তোমার হৃদয় স্পন্দন ধ্বংস করতে পারেনি,যুগে যুগে তুমি চির অম্লান মুক্তি আকাশে ধ্রুব তাঁরার মতই জ্বলবে। তোমার জুম্ম জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় আত্নবলিদান হোক আগামী দিনের গনজাগরণের আত্নপ্রত্যেয়ের প্রত্যাশা।প্রতি বছর এই দিনটি জাতি স্মরণ করিয়ে উজ্জীবিত করবে তোমায়।মাতৃভূমির জন্য ভালবাসায় পবিত্র রক্তের বিন্দুতে স্নান করে চির দিনের মত বিদায় নিলে এই পৃথিবীর মায়া থেকে।মরার মত মরার চেয়ে বীরের মত মরা।কারোর মৃত্যু স্বাভাবিক, আর কারো মৃত্যু অস্বাভাবিক থেকেও ভয়ংকর। কিন্তু যে মৃত্যু মানুষকে জীবুত রাখে,মানুষকে স্মরণে রাখে,ইতিহাস যাকে চির অম্লান করে রাখে,সেই মৃত্যুর ভাগীদার হলে তুমি।
সুদীর্ঘ লড়াইয়ের পরে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হলেও সরকার চুক্তি বিরোধী অপশক্তিকে জাগ্রত করতে ভুল করেনি।একদিকে শাসকগোষ্ঠী ইসলামীকরণ, অপর পক্ষে শাসকগোষ্ঠী লেজুর বাহিনী সংস্করণে ব্যাস্ত।নব্য সংস্করণ লেজুর বাহিনীরা জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের স্বার্থের বিরোধিতা করে, মুখের মিথ্যা প্রলাপণের বুলি দিয়ে, হৃদয় গ্রাস করে জয়সূচক হওয়ার গল্প।শাসকগোষ্ঠির হীন উদ্দেশ্যতা নিয়ে তেমন কোন অগ্রগতির দিকে অগ্রসর হতে পারেনি,বরং ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।লেজুর বাহিনীরা রাষ্ট্র পরিচালনা বাহিনী, চেয়েও বেশি কর্মদক্ষতা দিতে দণ্ড লঘূকরণে লিপ্ত।ক্ষমতালিপ্সু ও স্বার্থলোভী সংগঠনটি সর্বোপরি চুক্তি বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরকারী অন্যতম পক্ষ জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করার হীন কার্যকলাপ নিয়ে অগ্রসরমান এই দলটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অসমাপ্ত কাজগুলো বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর বলেই প্রতীয়মান।
এক দিকে রাষ্ট্রের জয়জয়কার ধ্বনি,অপর পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বহুজাতির বহুসংস্কৃতিকে ধ্বংসের হীন উদ্দেশ্যতা চলমান।যেখানে বহু ভাষা ভাষী ১৪ টি জাতিগোষ্ঠী বসবাস।তাদের আছে নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। কিন্তু রাষ্ট্র বরাবরই বহুজাতির বহুসংস্কৃতির জীব বৈচিত্র্যটাকে অস্বীকার করে চলেছে এবং এখনো তা চলমান। একরাষ্ট্র গঠনের হীন উদ্দেশ্য পায়তারার দিকে প্রতিনিয়ত ধাবিত হয়েছে রাষ্ট্র।পরিকল্পিত মহৎ উদ্দেশ্য চাপিয়ে দিয়ে আগ্রাসনেরনীতির মধ্যেদিয়ে সংস্কৃতি ধ্বংস করে, সমাজনীতিকে পাল্টে দিয়ে মনগড়া নকশা প্রতিফলনের চিত্র।স্বর্বপরি মানবতা বিরোধী কাজে পাকাপোক্ত।সম্প্রতি তিন পার্বত্য চট্টগ্রামে একের পর এক শাসকগোষ্ঠী জঘন্যতম চিত্র উপস্থাপনে নির্বিগ্নে, নির্বিচারে আদিবাসী হত্যা,ভূমি জবরদস্তি বেদখল চলমান রেখেছে ।অপর দিকে ইসলামিক সম্প্রসারণবাদকে চাপিয়ে দিয়ে ইসলামি করণ রূপকল্পও বাস্তবায়নের বদ্ধপরিকরে ভূমিকায় রাষ্ট্র।
যে শাসকগোষ্ঠী সন্ত্রাসী নিরসনকল্পে বিশ্বাসী, সে শাসকগোষ্ঠী নব্য সন্ত্রাসী সংস্করণে প্রবক্তা। শাসকগোষ্ঠীর মহল সন্ত্রাসে বিশ্বাসী এই চরিত্ররা নিষ্ঠুর, নির্মম, আবেগবর্জিত মৃত্যুর কারবারি। এদের একমাত্র লক্ষ্য, সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় নির্বিচারে মানুষ মারা এবং বিরোধী পক্ষকে ধ্বংসের ভয় দেখিয়ে নতজানু করা।৭১’ স্বাধীনতা সত্যিই কি ‘তাঁদের’ প্রাণের যথেষ্ট মূল্য?তাহলে রাষ্ট্র ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে বিনিময়ে ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে অর্জিত স্বাধীনতার লাল সবুজের পতাকা এনেছে।সে রাষ্ট্র কি ভাবে আরেক জাতির উপড় উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ,ইসলামিক সম্প্রসারণবাদ সমাজের জনসাধারণের ইতিহাসবোধ-গণস্মৃতির বাঞ্ছনীয় বিন্যাস তৈরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা চাপিয়ে দিতে পারে।দূরদর্শনে, অন্তরজালে সকল জাতির অস্তিত্ব রক্ষার্থে জীবনাশঙ্কা রেখে অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে পাঞ্জা লড়ে চলেছে,তাদেরকে সন্ত্রাসী আক্ষায়িত করা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদী শব্দটি কেবল ঔপনিবেশিক শাসকদের বিশ্লেষণী বর্গবিন্যাসের গা-জোয়ারি না, এটা পুরো দমে প্রভাব বিস্তার করেছে,শাসকগোষ্ঠি জেএসএস গণতান্ত্রিক আন্দোলকে ঠেকাতে গুম,হত্যা,মিথ্যা মামলা হয়রানি,বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সাজিয়ে নির্বিগ্নে নির্বিচারে হত্যা চলমান রেখেছে।জেএসএস গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ঠেকাতে শাসকগোষ্ঠি মরিয়া পদক্ষেপ গ্রহণে,পথভ্রষ্ট হবে অগ্রসর হতে পারবে না।
প্রয়াত নেতা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণসহ স্থায়ী অধিবাসীদের স্বশাসনের অধিকারকে উপেক্ষিত করা, বাংলাদেশের সকল জনগোষ্ঠীকে সংবিধানে বাঙালি বলিয়া পরিচয় করানোর বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদের ভেতরে-বাইরে এন এন লারমা লড়াই সংগ্রাম করেছিলেন এবং শাসকগোষ্ঠীর কাছে বার বার ধর্ণা দিয়েছিলেন।শাসকগোষ্ঠী এম এন লারমার বক্তব্যকে গুরুত্ব না দেওয়াতে এক সময় তাঁর প্রিয়জন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের কাছে ফিরে এসে বলেছিলেন, “এভাবে আর হবে না, অন্য রাস্তা ধরতে হবে”।পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ মৃত্যুর ভয়ে ভিত নয়, মৃত্যুকে পাহাড়ের মানুষ ভয় করে না, মৃত্যুকে তারা জয় করেছে। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামই তার প্রমাণ! আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, জুম্ম জনগণ তাদের অধিকারের জন্য প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে আপোষহীন লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে আসছে এবং তারমধ্যে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের বাস্তব ইতিহাস রয়েছে।
এক একটি পবিত্র দেহের আত্মবলিদান হাজার লক্ষ মানুষের শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।এক একটি পবিত্র দেহের আত্মবলিদান, আরেকটি মস্তিষ্ককে প্রতিবাদী সাহসী শপথে দাঁড় করে।এক একটি আত্নবলিদান এক একটি মায়ের কোল খালি করে, অশ্রু ঝড়ায়।অপর পক্ষে হাজার লক্ষ মায়ের চোখে-মুখে হাসি ফোঁটায়।লক্ষ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।ওহে, তরুণ বাস্তবতায় সঠিক সময়ের আহ্বানে আমাদেরকে দাঁড় করিয়েছে।যেমনটি একটি সঠিক লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছাড়া জাতীয় মুক্তির সম্ভব নয়।তেমনি অধিকার কোন ভিক্ষার জিনিস নয়,অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্তিত্ব লড়াই সংগ্রামে, আত্নবলিদান ভাগ্য হিসেবে গ্রহণ করা অধিকার স্বাদ ভোগী মানুষের সংখ্যাটাই খুব নঘন্য।তাহলে কোনটা আগে গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ধারণ করবেন,করণীয় কি হতে পারে উপস্হিতি সময়ের দাবী।মনে রেখো শাসকগোষ্ঠি দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় ধরে পেশিশক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। অদূর ভবিষ্যতেও পেশিশক্তি দিয়ে জুম্ম জনগণকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।হে তরুণ রাষ্ট্রের অপশক্তির কাছে অস্তিত্ব গ্রাস্যমান। তারুণ্যের পথচারণা ছাড়া অস্তিত্ব রক্ষা অসম্ভব।সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে চুড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে কদম মিলিয়ে হাঁটা ছাড়া বিকল্প রাস্তা নেই।জুম্ম জনগণের পিঠ দেওয়ালে আটকে গেছে।১৯৮৩ সালে জুম্ম জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা এমএন লারমারকে প্রবঞ্চকরা হত্যা করেছিল,তার চেতনা আদর্শকে ধ্বংস করতে পারেনি।জীবিত লারমা থেকে, মৃত লারমা বেশি প্রকত ও শক্তিশালী।প্রিয় কমরেড তোমার আহাজারি মৃত্যু ও বেঁচে থাকুক।
প্রিয় কমরেড 'রনক' তোমার স্বপ্নও বাঁচুক, আগামীর বিপ্লবে।
৩৬৫ টি দিন আমাদের ভিন্ন সময়ে কত আনন্দ দেয়,আর কত দুঃখ ও আবেগেরও সাথী হয়ে দাঁড়ায়।একটি বছর চলে যাওয়া মানে জীবন থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় হাঁড়িয়ে ফেলা।একটি বছর চলে যাওয়া মানে,আপনার আমাদের মৃত্যুর ঘন্টাকে আহ্বান করা।
'জীবন সংকীর্ণতায় রেখে পারিপার্শ্বিক পরিজনের মায়া ছিন্ন করে,পিতা-মাতার অভিশপ্ত জীবন নিয়ে জাতীয় অস্তিত্ব সংগ্রামে বিজয়গাঁথার অন্নেষণ করা ও অধিকারের স্বাদ মেটাতে পাহাড় ডিঙিয়ে ছুটে চলা সেই যৌবন উৎসর্গ করা বন্ধুদের জন্য আগামীর নতুন সূর্যোদয়ের কিরণ ছড়িয়ে পড়ুক।
No comments:
Post a Comment